আখিরাত অর্থ পরকাল। পরকাল হলো ইহকালের বা দুনিয়ার জীবনের পরের জীবন। দুনিয়ার জীবনই মানুষের শেষ জীবন নয়। বরং মানুষের জন্য আর একটি জীবন রয়েছে। সে জীবনই পরকালীন জীবন। পরকালীন জীবন অনন্ত। এ জীবনের শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন-
إِنَّمَا هُذِهِ الْحَيَوةُ الدُّنْيَا مَتَاعٌ : وَإِنَّ الْآخِرَةَ هِيَ دَارُ الْقَرَارِ
অর্থ: "এ দুনিয়ার জীবনতো অস্থায়ী উপভোগের বস্তুমাত্র। আর নিঃসন্দেহে আখিরাতই হলো চিরস্থায়ী আবাস।" (সূরা আল-মু'মিন, আয়াত ৩৯)
আখিরাতে বিশ্বাসের গুরুত্ব
আখিরাতে বিশ্বাস ইমানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আখিরাতে বিশ্বাস করা অপরিহার্য। আখিরাত অবিশ্বাস করলে মানুষ ইমানদার হতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের গুণাবলি সম্পর্কে বলেন-
وَبِالْآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ *
অর্থ: "আর তাঁরা (মুত্তাকিগণ) আখিরাতের উপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে।" (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ৪)
আখিরাত হলো পরকাল। কবর, হাশর, মিযান, সিরাত, জান্নাত-জাহান্নাম ইত্যাদি আখিরাতের একেকটি পর্যায়। এ সবকটি বিষয়ের প্রতি আমাদেরকে ইমান আনতে হবে। কোনোটিই অবিশ্বাস করা যাবে না। বলা হয়ে থাকে
الدُّنْيَا مَزِرَعَةُ الْآخِرَةِ
অর্থ: 'দুনিয়া হলো আখিরাতের শস্যক্ষেত্র।'
অর্থাৎ দুনিয়া হলো আমল করার স্থান। আখিরাত হলো ফলভোগের স্থান। সেখানে মানুষ কোনো আমল করতে পারবে না। বরং দুনিয়াতে মানুষ যেরূপ আমল করেছে সেরূপ ফল ভোগ করবে। কৃষক শস্যক্ষেত্রে যেরূপ চাষাবাদ করে, সেরূপই ফল লাভ করে। জমিতে ধান লাগালে ফসল হিসেবে ধানই পাওয়া যায়। আর কেউ যদি জমিতে কাঁটাগাছ রোপণ করে তবে সে শুধু কাঁটাই লাভ করে। দুনিয়ার জীবনও তদ্রূপ। আর দুনিয়াতে যে ব্যক্তি ইমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, সে আখিরাতে সম্মান ও মর্যাদা লাভ করবে। তাঁর আবাসস্থল হবে চিরশান্তির স্থান জান্নাত। অন্যদিকে যে ব্যক্তি ইমান আনবে না এবং অন্যায় ও খারাপ কাজ করবে, আখিরাতে সে শাস্তি ভোগ করবে। তার ঠিকানা হবে শাস্তি ভোগের স্থান জাহান্নাম। সে জাহান্নামের আগুনে চিরকাল পুড়বে। আখিরাতে কোনো মানুষ মৃত্যুবরণ করবে না। বরং চিরকাল ধরে শান্তি অথবা শাস্তি ভোগ করবে।
আখিরাতে বিশ্বাস করলে মানবজীবন সুন্দর হয়। মানুষ উত্তম চরিত্রবান হিসেবে গড়ে ওঠে। আখিরাতে বিশ্বাস মানুষকে সব ধরনের খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। এ বিশ্বাসের ফলে মানুষ কোনোরূপ অন্যায়, অত্যাচার, দুর্নীতি, মিথ্যাচার, অশ্লীল কাজকর্ম করতে পারে না। বরং সে সর্বদা উত্তম ও নেক কাজে আগ্রহী হয়। আখিরাতে শান্তির আশায় মানুষ দুনিয়াতে ভালো গুণাবলির অনুশীলন করে। ফলে মানবসমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
অতএব, আমরা আখিরাতের প্রতি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করব। আখিরাতে শান্তি ও সফলতা লাভের জন্য দুনিয়ায় নেক আমল করব। আমাদের দুনিয়ার জীবন শান্তিময় হবে। আর পরকালে আমরা জান্নাত লাভ করব।
সিরাত (الصِّرَاطٌ)
সিরাত শব্দের অর্থ পথ, রাস্তা, পুল, পদ্ধতি ইত্যাদি। ইসলামি পরিভাষায়, সিরাত হলো জাহান্নামের উপর স্থাপিত একটি পুল। এ পুল পার হয়ে জান্নাতিগণ জান্নাতে প্রবেশ করবেন। আখিরাতে সকল মানুষকেই এ পুলের উপর আরোহণ করে তা অতিক্রম করতে হবে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা সকল মানুষের কৃতকর্মের হিসাব নেবেন। যে নেক আমল করবে মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতে যাওয়ার অনুমতি দেবেন। জান্নাতিগণ সিরাতের উপর দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবেন। তাঁদের আমল অনুসারে সিরাত নানারকম হবে। কারো জন্য সিরাত হবে বিশাল ময়দানের মতো। আবার কম নেককারদের জন্য তাদের আমল অনুসারে সিরাতের প্রশস্ত কম হবে। ইমানদারগণ নিজ নিজ আমল অনুযায়ী সিরাত অতিক্রম করবেন। কেউ বিদ্যুৎগতিতে সিরাত পার হবেন। কেউ ঝড়ের গতিতে, কেউ ঘোড়ার গতিতে, কেউ দৌড়ের গতিতে, আবার কেউ হেঁটে হেঁটে সিরাত পার হবেন। কম আমলকারী জান্নাতিগণ হামাগুড়ি দিয়ে অতিকষ্টে সিরাত পার হবেন।
সিরাত হলো অন্ধকার পুল। সেখানে ইমান ও নেক আমল ব্যতীত আর কোনো আলো থাকবে না। সুতরাং দুনিয়ায় যে দৃঢ় ইমান এবং বেশি নেক আমলের অধিকারী হবে, সিরাত হবে তাঁর জন্য সবচেয়ে বেশি আলোকিত। ইমানের আলোতে সে সহজেই সিরাত অতিক্রম করবে। জান্নাতিগণের মধ্যে সর্বপ্রথম আমাদের প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মদ (স.) সিরাত অতিক্রম করে জান্নাতে প্রবেশ করবেন। তাঁর পূর্বে কেউই এ মর্যাদা লাভ করবে না।
অন্যদিকে জাহান্নামিদের জন্য সিরাত অত্যন্ত ভয়াবহ স্থান। তাদের জন্য সিরাত হবে চুলের চাইতেও সূক্ষ্ম এবং তরবারি অপেক্ষা ধারালো। সেখানে কোনো আলো থাকবে না। বরং সিরাত হবে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এমন অবস্থায় তারা সিরাতে আরোহণ করবে। তারা কিছুতেই সিরাত অতিক্রম করতে পারবে না। বরং তাদের হাত-পা কেটে তারা জাহান্নামে পতিত হবে।
সিরাত সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন,
وَإِنْ مِنْكُمْ إِلَّا وَارِدُهَا كَانَ عَلَى رَبِّكَ حَما مَقْضِيًّا ؟
অর্থ: "এবং তোমাদের প্রত্যেকেই তা অতিক্রম করবে, এটা তোমার প্রতিপালকের অনিবার্য সিদ্ধান্ত।” (সূরা মারইয়াম, আয়াত ৭১)
এ সম্পর্কে মহানবি (স.) বলেন,
يُوضَعُ الصِّرَاطُ بَيْنَ ظَهْرَى جَهَنَّمَ
অর্থ: "জাহান্নামের উপর সিরাত স্থাপিত হবে।” (মুসনাদে আহমাদ)
আমরা সিরাতে বিশ্বাস করব। সহজে সিরাত অতিক্রম করার জন্য দুনিয়াতে বেশি বেশি নেক আমল করব।
মিযান (الْمِيزَانُ )
মিযান অর্থ দাড়িপাল্লা, তুলাদণ্ড, মানদণ্ড বা পরিমাপ করার যন্ত্র। ইসলামি পরিভাষায়, যে পরিমাপক যন্ত্রের দ্বারা কিয়ামতের দিন মানুষের পাপপুণ্যকে ওজন করা হবে, তাকে মিযান বলা হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَنَضَعُ الْمَوَازِينَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيمَةِ
অর্থ: "আর আমি কিয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের মানদণ্ড স্থাপন করব।" (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত ৪৭)
আমরা নিশ্চয়ই দাড়িপাল্লা দেখেছি। এর দুটি পাল্লা থাকে এবং মাঝে একটি দণ্ড থাকে। এগুলোর মাধ্যমে আমরা নানা জিনিস পরিমাপ করে থাকি। মিযানও তেমনি একটি মানদণ্ড। এর দুটি পাল্লাতে মানুষের সকল আমল ওজন করা হবে। এর এক পাল্লায় থাকবে পুণ্য এবং অন্য পাল্লায় উঠানো হবে পাপ। যে ব্যক্তির পুণ্যের পাল্লা ভারী হবে সে হবে জান্নাতি। আর যে ব্যক্তির পুণ্যের পাল্লা হালকা হবে এবং পাপের পাল্লা ভারী হবে, সে জাহান্নামি হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন
فَمَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ، وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُ وا أَنْفُسَهُمْ فِي جَهَنَّمَ خَالِدُونَ ؟
অর্থ: "এবং যাদের পাল্লা (পুণ্যের) ভারী হবে, তারাই হবে সফলকাম। আর যাদের পাল্লা হালকা হবে, তারাই নিজেদের ক্ষতি করেছে, তারা জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে।" (সূরা আল-মুমিনুন, আয়াত ১০২-১০৩)
মিযানের পাল্লায় পুণ্য বা নেক কাজ বেশি হলে মানুষ সফলতা লাভ করবে। তার সস্থান হবে জান্নাত। এজন্য বেশি বেশি নেক কাজ করা উচিত। প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মদ (স.) আমাদের নেকির পাল্লা ভারী করার জন্য বহু আমল শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলেন-
الْحَمْدُ لِلَّهِ تَمْلَأُ الْمِيزَانَ
অর্থ: 'আল-হামদুলিল্লাহ' বলা মিযানের নেকির পাল্লা পূর্ণ করে দেয়।' (সহিহ মুসলিম)
অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- 'দুটি বাক্য এমন আছে, যা দয়াময় আল্লাহর নিকট প্রিয়, উচ্চারণে সহজ এবং মিযানের পাল্লায় ভারী। এ দুটি বাক্য হলো-
سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ سُبْحَانَ اللَّهِ الْعَظِيمِ -
উচ্চারণ: সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি, সুবহানাল্লাহিল আযিম।
আমরা এ দোয়া দুটি শিখব এবং বেশি বেশি পাঠ করব। এতে আমাদের নেকির পাল্লা ভারী হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের ভালোবাসবেন এবং আমরা আখিরাতে সফলতা লাভ করব।
দলগত কাজ: আখিরাতে বিশ্বাসের গুরুত্ব। |
বাড়ির কাজ: আখিরাতের পর্যায়গুলোর একটি তালিকা তৈরি কর। |
Read more